এক.
আমি আমার এপার্টমেন্টের প্রসারিত বারান্দার আরাম কেদারায় শরীর এলিয়ে দিয়ে দূরবীনটায় চোখ রেখে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছি। সবুজে ঘেরা, প্রশান্ত চাঁদ। সেখানে হৃদয়ের আকৃতিতে গড়া কয়েকটা কৃত্তিম কিন্তু মনোরম লেক, খালি চোখেও দেখা যায়। দূরবীনটা অনেক শক্তিশালী, এটা দিয়ে ইচ্ছে করলে ওখানকার মনুষ্য চলাচলও অবলোকন করা সম্ভব। কিন্তু আমার দূর থেকেই দেখতে ভাল লাগে। এক সময় চাঁদে, পানি বা অক্সিজেন বা বায়ূমন্ডল ছিলনা। ফলে পৃথিবীর বুকে সৃষ্ট প্রানীকুলের সেখানে বসবাস সম্ভব ছিলনা। সেই সময়ে চাঁদের গায়ে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে পৃথিবীর বুকে এক মায়াময়, রহস্যময় আলো ছড়িয়ে দিত, সে নাকি এক বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল। এর আলোকে বলা হতো জোছনা। পূর্ণিমা রাতে চাঁদের রূপ নাকি ছিল বর্ণনাতীত সুন্দর। চাঁদের বুকে পাহাড়ি এলাকায় যে ছায়া পড়তো, তাকে বলা হত চাঁদের কালিমা। কলিমা থাকলেও প্রানপ্রিয় প্রেয়সীকে চাঁদের সাথে তুলনা করতে দ্বিধা করত না কেউ। প্রেয়সীও তেমন তুলনায় আপ্লুত হয়ে যেত। শিল্প সাহিত্যে কত লক্ষ কোটি বার সেই সৌন্দর্য, রূপ বর্ণনা করা হয়েছে তার ইয়াত্যা নেই। এই সময়ে এখনকার মানুষের কাছে সেই সব বর্ণনাই বিস্ময়কর এক রহস্য। শুধুকি সৌন্দর্য বর্ণনা? এক কিশোর কবি লিখেছিলেন, ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।
পৃথিবীর মানুষের কাছ থেকে চাঁদটাকে লুটে নেয়া হয়েছে ঠিকই, মানুষের দারিদ্রতা কমেছে কিন্তু নিঃশেষ করা যায়নি, বুভুক্ষু মানুষের আহাজারী এখনো শোনা যায়। আজও দারিদ্র কিছু মানুষের কাছে নিতান্তই এক বাণিজ্যিক পণ্য।
আজ থেকে প্রায় ৭৫ বছর আগে চাঁদের পৃষ্ঠে অক্সিজেন ও পানি তৈরির একটা প্রকল্প সফলতার সাথে সম্পন্ন হয়। তারপর চাঁদের দখল নেয়ার জন্য পৃথিবীতে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। অবশেষে এক ট্রিটির মাধ্যমে এক শািন্তপূর্ণ সমাধান হয়। কিন্তু ধনিক আর প্রযুক্তি সমৃদ্ধ দেশ গুলোই এর সিংহ ভাগ দখল নিয়ে নেয়। তারপর প্রায় ৫০ বছর ধরে চলে চাঁদের জলীয়করন এবং সবুজায়ন। স্বর্গের বর্ণানুসারে চাঁদের সৌন্দর্য গড়ে তোলা হয়েছে। এখন এটা পৃথিবীর ধনিক শ্রেণীর বিলাসিতার তীর্থ স্থান। আমার কাছে যা শ্রেণীবৈষম্যর এক কদর্য নমুনা। যেমন সবাই তাজমহলের (যদিও মূল তাজমহলটি এখন আর নেই, এর হুবহু একটা রেপ্লিকা তৈরি করা হয়েছে) শুধু সৌন্দর্য দেখতে পায়, ভালবাসার সরূপ দেখতে পায় আমি তার বিপরিতে এর কদর্যটাও দেখতে পাই। আবার একই সাথে সৌন্দর্যে বিমোহিতও হই। মানুষের সৃষ্টির ক্ষমতা দেখে বিস্মত হই।
রিহনা হয়তো এখন পৃথিবীর সব চাইতে সুখি মানুষের একজন হতে পারতো। তার স্বপ্নের আরেক নাম ছিল চাঁদের হৃদয় আকৃতির নীল জলাশয়ে সাতার কাটা। কিন্তু বেচারির ভাগ্যে নেই। নয়তো আগামি দুই বছর সে চাঁদের বুকে থাকতে থাকতে তিতি বিরক্ত ও অস্থির হয়ে যেত।
চাঁদে বিলাস করতে যাওয়ার মত ধনকুবের আমি নই, হলেও হয়তো যেতাম না। কিন্তু আমাকে যেতে হচ্ছে। চাঁদের ভিক্টর জোনের সিকিউরিটি ইনচার্জ হিসাবে বদলি করা হয়েছে। আগামি দুই বছর এই জোনের নিরাপত্তা আমার হাতে নেস্ত থাকবে। ভিক্টর জোন মোট আটটি জোনের মধ্যে একটি। সব চেয়ে মনোরম লেকটি এই জোনে অবস্থিত। হৃদয় আকৃতির লেকটা থেকে আল্পনার কারুকাজের মত ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে নদী। সেই নদীর ধার ঘেষে তৈরি করা হয়েছে বিলাস বহুল কটেজ। লেকের স্বচ্ছ জলে খেলা করে বেড়ায় বিভিন্ন প্রজাতি এবং রং-বেরং এর মাছ। ভিক্টর জোনের একটা অংশ নাইট এঞ্জেল। চাঁদের অন্ধকার অংশে গড়ে তোলা জমকাল এক শহর।
চাঁদ পৃথিবীর অক্ষে ঘুরছে কিন্তু নিজের অক্ষে স্থির ফলে একটা অংশ সব সময় আলোকিত, যে অংশ টুকু আমরা দেখতে পাই। আরেক অংশ নিকষ কাল অন্ধকার। যদিও নাইট এঞ্জেলের আলো কখনোই নেভে না। নাইট ক্লাব, কেসিনো গুলোতে সারাক্ষন চলছে আনন্দ, ফুর্তি আর উৎসব।
রিহনা এবং আমি দু' জনই নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরে বেড়ে উঠেছি। আমার কৈশোর কেটেছে নিতান্ত টানাটানিতে। শুনেছি রিহনাদেরও কষ্টের সংসার ছিল। দরিদ্র হলেও আমি ছিলাম মেধাবিদের দলে। কিশোর বয়স থেকেই কাজ করে গ্রাজুয়েশনটা শেষ করছিলাম। কিন্তু ইচ্ছা থাকলেও আর অগ্রসর হতে পারিনি। রিহনা পড়ালেখা ছেড়ে দিয়েছিল অনেক আগেই। কফি সপে কাজ করতো ও। সেখানেই ওর সাথে আমার পরিচয়। মন দেয়া নেয়া এবং বিয়ে। তখন আমাদের বয়স আর কত? অল্প বয়সেই বিয়ে করেছিলাম আমরা।
বিয়ের পর খরচপাতি বেড়ে গেল। ভালো পোর্টফলিও না থাকায়, ভাল কোন চাকরিও জুটছিল না। টানাটানিতে চলছিল সংসার। তবে ভাল কিছুর চেষ্টায় ছিলাম। বিয়ের পর রিহনাকে অল্প অল্প চিনতে শুরু করলাম। ওর উচ্চািবলাস ছিল ভয়ংকর। প্রায়ই সে কারনে অকারনে ঝগড়া করতো। একদিন না বলে কোথায় যেন চলে গেল। একটা চিরকুট পাওয়া গেল, তাতে লেখা "তোমার টানাটানির সংসারের ঘানি তোমাকে সমার্পন করলাম। আমাকে খোঁজার বৃথা চেষ্টা করো না।" আমি তাকে খোঁজার চেষ্টা করিনি। বরং মুক্তির আনন্দই পেয়েছিলাম। কিন্তু আমার মধ্যে একটা পরিবর্তন হল। মনের ভেতর জমা হলো জেদ। পরের দিনই সেনাবাহীনিতে যোগ দিলাম। আমার স্বাস্থ্য আর শরীরের গড়ন আমাকে বাহিনিতে যোগ দিতে সহায়তা করেছিল। ছয় মাসের মাথায় ট্রেনিং দিয়ে আমাকে আফগান পাকিস্তান সীমান্তে পাঠিয়ে দেয়া হল। সে সময় ভয়ংকর যুদ্ধ চলছে ওখানে। জানের মায়া কি জিনিষ ভুলেই গিয়েছিলাম। শাহসীকতার জন্য অল্প সময়ের মধ্যে বাহিনিতে আমার সুনাম ছড়িয়ে পড়ল। পিছু টেনে রাখা কার সাধ্যি? অল্প সময়ের ভেতরেই কর্তাব্যাক্তি হয়ে উঠলাম। মৃত্যুর পিছনে ধাওয়া করে ছুটতাম বলে মৃত্যু আমার ধার কাছে ঘেষতো না।
এক সময় এক ঘেয়েমি লেগে গেল। হঠাৎ করেই সেনাবাহীনির কাজটা ছেড়ে দিলাম। পুলিশে যোগদান করলাম। আমার পূর্ববর্তী কাজের অভিজ্ঞাতাকে অগ্রাধিকার দেয়া হল। এখানেও দ্রুত নিজের অবস্থান তৈরি করে নিলাম। নারীর প্রতি এক ধরনের বিতৃষ্ণা জন্মেছিল মনের মধ্যে, তাই আর কোন নারীর আগলে বন্দি হতে চাইনি। কাজের মাঝেই ডুবে থাকি সব সময়। এটাও আমার কাজের উন্নতির পিছনে সহায়তা করেছে।
অনেক রাত হয়েছে। আমি বারান্দা থেকে আমার রুমে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। আগামি কাল লম্বা ক্লান্তিকর ভ্রমন একটু ঘুমিয়ে নেয়াই শ্রেয়। বিছানায় পড়লেই আমার ঘুম চলে আসে। আজকে কেন যেন ঘুম আসছেনা। বালিশ অদল বদল করে, এপাশ ওপাশ করে চেষ্টা করলাম কিন্তু লাভ হচ্ছেনা। অচেনা এক অস্থিরতা। শংকা কি? আমার আবার শংকা কিসের! যার কাছে মৃত্যু একটা ঘটনা মাত্র।
দুই.
চাঁদের বুকে হাটার জন্য বিশেষ ধরনের জুতা পড়তে হয়। চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি পৃথিবীর চাইতে কম তাই এখানে ওজন কম। স্বভাবতই এখানে পৃথিবীর মত করে হাটা সম্ভব নয়। এই বিশেষ ধরনের জুতায় মাধ্যাকর্ষণ মাত্রাকে পৃথিবীর মত করে দেয় ফলে মানুষ স্বাভাবিক ভাবেই হাটতো পারে। তবে এই জুতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে সময় লাগে। কিন্তু আমার তেমন সমস্যা হচ্ছে না। দীর্ঘ পথ পরিক্রমা ক্লান্তিকর মনে হলেও আসলে মোটেও ক্লান্তিকর নয়। ভ্রমনের সময় মস্তিষ্কের ভেতর এক ধরনের সিমুলেশন দেয়া হয়। জীবনের সব সুখ স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠে বিশেষ করে কৈশোরের দূরন্তপনা, বল্গা হারা সময়। যে সময়ে অভাব, অনটন পাগলামিপনাকে রহিত করতে পারে না। আমিও সেই স্মৃতির সাগরে ভাসতে ভাসতেই চাঁদের পৃষ্ঠে অবতরন করলাম।
মাধ্যাকর্ষণের পার্থক্য হঠাৎ করে চমকে যাওয়ার মত। বেশ উপভোগ্য, আমার হাতের কমিউনিকেশন ডিভাইসটি ফেলে দিলাম সেটা দুলে দুলে নিচে নামছে, মাটি স্পর্শ করার অনেক আগেই ওটাকে ধরে ফেললাম। পৃথিবীর বুকে যা কখনোই সম্ভব না। আরেক বার ফেলে দিয়ে ফের ধরলাম। বেশ মজা লাগলো।
আমার জন্য একটা রোবোটিক গাড়ি অপেক্ষা করছিল। আমাকে আমার আবাসনে পৌছে দেয়ার জন্য, এক দিন আমাকে বিশ্রামে থাকতে হবে। গাড়িতে উঠতেই, একটা কোমল নারী কন্ঠ আমাকে স্বাগত জানাল, "সুপ্রভাত ইরন, তোমার ভ্রমন নিশ্চই আনন্দময় হয়েছে? তোমাকে এখন তোমার আবাসনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেখানে তুমি একদিন সম্পূর্ন বিশ্রামে থাকবে।"
: ধন্যবাদ। এখানে আমি বিশ্রামে আসিনি। অফিসে চল, দ্বায়িত্বটা বুঝে নেই।
: বর্তমানে এখানে সব কিছুই নিয়ন্ত্রনে আছে। অবশ্য সবসময়ই ছিল। আগামি কাল কাজ শুরু করলেও কোন অসুবিধা হবে না।
: আমি রবোটদের অপ্রয়োজনীয় কথা বলা একদম পছন্দ করি না। নির্দেশ মোতাবেক কাজ কর।
: দুঃখিত ইরন। চল তোমার অফিসে।
প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার বেগে গাড়িটা ছুটলো আমার অফিসের দিকে। ১৫ মিনিটের মাথায় আমরা অফিসে পৌছে গেলাম। অভ্যর্থনাকারি অফিসার আমাকে আমার অফিস কক্ষে নিয়ে গেল। তার মাধ্যমে অফিসে উপস্থিত সবাইকে ডাকলাম আমার কামড়ায়। পরিচিত হয়ে নিলাম সবার সাথে। কথা বলতে বলতে সহযোগীদের মনোভাব জানার চেষ্টা করলাম। সবার কাছে জানতে চাইলাম আইন শৃৃঙ্খলা ভাল রাখার জন্য কার কি পরামর্শ। সবাই এক এক কররে তাদের মতামত দিল। আমি কিছু কিছু নোট করে নিলাম। তবে সবার কথা হচ্ছে আইন শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হওয়ার কোন সুযোগ নেই। তবে যারা বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠানে কাজ করে তাদের নজরে রাখাই তাদের প্রধান কাজ।
: কেন যারা বিলাস যপনে আসে তারা কোন অপরাধ করে না?
কেউ কোন কথা না বলে চুপ করে রইল। আমি আবার জানতে চাইলাম, কোন সমস্যা? কিন্তু তথাপি সবাই নিরুত্তর।
: ঠিক আছে, সবাইকে অনেক ধন্যবাদ। আপনারা যার যার কাজে চলে যান সবাই মিলে নিশ্চয় আমরা আমাদের কাজ সফলতার সাথেই করতে পারবো।
সবাই আমার সাথে হাত মিলিয়ে যার যার কাজে ফিরে গেল। সবাই চাঁদে আমাকে স্বাগতম করল।
নিজ কক্ষে বসে আমি কিছু পুরানো নথি ঘাটাঘাটি করলাম। আগে যে দ্বািয়ত্বে ছিল তার কিছু রিপোর্ট পড়লাম। অস্বাভাবিক কিছু বা বিশেষ নজর কাড়া কিছু চোখে পড়লো না।
এখানে সময়ের হিসাব বিদঘুটে। পৃথিবীর হিসাবে চার পাঁচ ঘন্টার মত কাজ করে আমার আবাসনের দিকে রওনা হলাম। এখন এমন ক্লান্ত লাগছে যে, মনে হচ্ছে রবোটের কথা শোনাই সঠিক ছিল।
পরের বেশ কয়েক দিন ব্যস্ত সময় কাটালাম। বিভিন্ন সাব জোন, বার, ক্যাসিনোতে ঘুরে ঘুরে সেগুলোর আইন শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কি করা হয়েছে, সে গুলো কিভাবে কাজ করছে। না করলে কি করার আছে সেগুলো বিশ্লেষন করে করনিয় কি তার একটা তালিকা করলাম। তাছাড়া রুটিন কাজ গুলো নিয়মিত দেখভাল করছিলাম। এছাড়া ভিক্টর জোনের সিকিউরি সাইটে আমার ব্যক্তিগত কমিউনিকেশন নম্বরটা জুড়ে দিলাম। অনুরোধ করলাম, আপনি যে হোন, যেখানে হোন এবং আপনার সাথে অন্যায় করছে সে যে হোক, এবং যেখানে হোক, আমাকে জনান।
তিন.
যেমনটা ভেবে ছিলাম সেটা হয়নি। কোন উটকো অযাচিত ফোন বা ম্যসেজ পাইনি। আমি একটু আবাকই হলাম। চাঁদ তার নিজ অক্ষে ঘুরে না বলে তার সকাল, বিকাল বা রাত বলে কিছু নেই। পৃথিবীর সাথে মিল করার জন্য এখানে সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা বা রাতের একটা আবহ তৈরি করা হয়। সন্ধ্যায় সবাই নাইট এঞ্জলে চলে যায়। ডিনার করে, তারপর সময় বাড়ে রাত জমে।
বিকেলের দিকে কাজ শেষ করে আমার আবাসনে ফিরবো তখন মেসেজটা পেলাম, "আপনার সাথে এক পেয়ালা কফি পান করতে চাই।" মেসেজটাতে বেশ সুদ্ধতা বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। সাথে একটা রেস্টুরেন্টের নাম, সময় আর টেবিল নম্বর তের লেখা আছে।
হুম্ আন লাকি থার্টিন, মনে মনে বললাম। আমি সময় মতই রেস্টুরেন্টে পৌছালাম। তের নম্বর টেবিলে একজন ৩০-৩২ বছরের মহিলা বসে আছে। ভাল করে লক্ষ করলেই বোঝা সম্ভব মেয়েটা নাইট ক্লাবের ডেন্সার, কল গার্ল। পৃথিবী থেকে বাছাই করে বিলাস যাপনে আগত পুরুষদের মনরঞ্জনের জন্য পাঠানো হয়েছে এদেরকে। আমি টেবিলের কাছে না গিয়ে দূর থেকেই মেয়েটাকে লক্ষ্য করলাম। ভাবছি আমার কাছে এর কি দরকার থাকতে পারে? মেয়েটাকে অস্থির মনে হচ্ছে, একটু ভীতসন্ত্রস্ত। মনে হয় মেয়েটা কোন সমস্যায় আছে।
কথা বলে বুঝতে হবে। আমি তের নম্বর টেবিলের সামনে গিয়ে দাড়াতেই, মেয়েটা আমার দিকে তাকাল। ঝট করে উঠে দাড়াল, হাত বাড়িয়ে বলল, “আমি নিয়না”
: তোমার সাথে পরিচিত হতে পেরে খুশি হলাম নিয়না। আমি ইরন। বসতে বসতে বললাম, তুমি নিশ্চয় কোন কাজে আমাকে ম্যাসেজ করেছো?
নিয়নাও বসল। হুম্, জিভ দিয়ে ঠোট ভিজিয়ে বলল নিয়না।
: বলো, কোন সমস্যায় আছে?
টেবিলে একটু ঝুকে ফিস ফিস করে বলল নিয়না, “আমার রুমমেটকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”
: তুমি নিরাপত্তা কাউন্সিলে কেন অভিযোগ করছ না?
: অভিযোগ করলে হয়তো আমাকেও আর পাওয়া যাবে না।
: ও আচ্ছা। আমাকে বিশ্বাস করার কারন কি?
: আমি জানি না।
: কি নাম তোমার রুমমেটের?
: রাইনা। অবশ্য এগুলো নকল নাম। আসল নাম কি আমিও জানিনা।
: কবে থেকে তাকে পাওয়া যাচ্ছে না?
: গত রাত থেকে।
: তাহলে অস্থির হচ্ছো কেন হয়তো এসে যাবে।
: তার কমিউনিকেশন ডিভাইসটি বন্ধ।
: বন্ধ করে রাখতে পারে।
নিয়না আবার টেবিলে ঝুকে ফিসফিস করে বলল, "আমার মনে হয়, ওকে মেরে ফেলেছে।"
: কি বলছ, এসব! এমন মনে হওয়ার কারন?
: আমার আরেক বন্ধু ওদের হাত থেকে অল্পের জন্য বেঁচে গেছে। ওরা মনে হয় সাইকো, খুন করে মজা পায়। ওর কাছে রইনার খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পেরেছি।
: তুমি বলছ ওরা, তাহলে সাসপেক্ট একের অধিক। তোমার বন্ধুর সাথে কথা বলা দরকার।
: হুম্। কিন্তু ও কথা বলবে না। বলেছিলাম, ও ভয় পেয়েছে।
: তুমি ভয় পাও নাই?
: পেয়েছি, এখনো পাচ্ছি।
: তোমার কোন ভয় নেই। কিন্তু তোমার বন্ধুর সাথে কথা বলতে পারলে সাসপেক্টকে ধরতে সহজ হতো।
: আমি জানি ওরা কারা।
: তাই নাকি?
নিয়না তার ডিভাইসটি এগিয়ে দিল। দুই জন যুবকের ছবি। একজন কৃষ্ণাঙ্গ, একজন সাদা চামড়া। আমি নিয়নার ডিভাইস থেকে আঙ্গুলের ইশারায় ছবিটা আমার ডিভাইসে পাঠিয়ে দিলাম। নিয়নাকে তার ডিভাসটি ফিরিয়ে দিতে দিতে বললাম, "সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া কোন ব্যবস্থা নেয়া কঠিন। তবে দেখছি কি করা যায়।"
চার.
পরদিন অফিসে এসে প্রথমেই নিয়নার কেইসটা হাতে নিলাম। বিষয়টা খতিয়ে দেখতে হবে। তবে একটা বিষয় কোন ভাবেই বুঝে উঠতে পারছিনা, এরা আইনের সাহায্য নিতে এত ভয় পাচ্ছে কেন? নিশ্চয় আইন প্রয়োগকারীরা এদেরকে সহায়তা করে না। কিন্তু সহকর্মীদেরতো অসৎ মনে হয়না তার। তবে জুজুর ভয়টা কি?
আমি ডিভাইসটাতে কৃষ্ণাঙ্গ যুবকের ছবির উপর আঙ্গুল রেখে সার্চ অপশনে ক্লিক করলাম। গুগোল সার্চ বেশ কিছু লিঙ্ক ধরিয়ে দিল। তার মধ্যে একটি তার ফেসবুক প্রোফাইল লিংক। ৮০ বছর ধরে গুগোল, ফেসবুক পৃথিবীর মানুষের কাছে এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। মহাকাশ নেট এর মাধ্যমে পৃথিবীর তথ্যভান্ডরে সরাসরি সংযুক্ত হওয়া যায়। আমি ফেসবুক প্রোফাইল লিংকটাতে স্পর্শ করতেই থ্রিডি প্রোফাইলটা ওপেন হলো। ছি! কারও প্রোফাইল এত নোংরা হতে পারে, চিন্তাও করা সম্ভব না। বিভৎস ভলগার, নগ্নতা আর অশ্লিল জিনিষে ঠাসা একটা পাতা। এর পরিচয় জেনে আমার মাথা ঘুরে যাওয়ার মত অবস্থা। উগান্ডার স্বৈরশাসকের ছেলে মোগাম্বি। সরকার প্রধানের ছেলের পেজ এমন নোংরা হতে পারে? এরাযে সব কিছুকে থোরাই কেয়ার করে বোঝা যাচ্ছে। যার রুচিবোধ এত খারাপ তার পক্ষে এর চে' নোংরা কাজ করাও সম্ভব। তবে আমি পুলিশ, শুধু এর ভিত্তিতেই কোন কনক্লুশনে যেতে চাইনা। বিনা অভিযোগে এদেরকে ধরে এনে পুছপাছ করাও ঠিক হবে না। আমাকে উল্টো পথেই হাটতে হবে।
নিয়নার কাছ থেকে রাইনার ভিক্টর জোন এক্সেস নম্বরটা নিয়েছিলাম ওটা আমার দুই জন সহকর্মীকে দিয়ে, একে খুঁজে, ধরে নিয়ে আসার জন্য বললাম।
বিকেল তিনটার দিকে সহকর্মী জানালো, রাইনাকে পাওয়া গেছে, তবে জীবিত নয় মৃত। তাকে জঙ্গলে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। আমি বিন্দু মাত্র দেরি না করে ছুটলাম, যেখানে লাশ পাওয়া গেছে সেখানে। পৌছে দেখি ফরেন্সিক টিম পুরো এলাকা ঘিরে রেখেছে, সম্ভাব্য ক্লু পাওয়ার জন্য এলাকাটা স্কেনিং করছে। লাশটাকে ততক্ষনে প্যাকিং করা হয়েছে, মর্গে নিয়ে যাওয়া হবে। আমি লাশের কাছে যেতেই আমার সহকর্মী ব্যাগের চেন খুলে আমাকে দেখালো। লাশটা দেখে আমি চমকে উঠলাম। ছিটকে পিছিয়ে গেলাম। সহকর্মী একজন অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো, স্যার কোন সমস্যা?
আমার সম্বিৎ ফিরে পেতে একটু সময় লাগল। কোন রকমে বললাম, "এর নাম রাইনা নয়, এর আসল নাম রিহনা।"
পাঁচ.
রিহনার প্রতি আমার ভালো লাগার কোন টান অবশিষ্ট ছিল না। ওর অভাব বোধ করিনি কখনোই। কিন্তু তার এই পরিনতি কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না আমি। মোগাম্বি এবং তার সাদা চামড়া বন্ধুকে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে। সাসপেক্টকে আইডেন্টিফাই করতে কোন বেগ পেতে হয়নি। গুগোল ট্রেস ট্র্যাক যাচাই করেই তাদেরকে ধরা সম্ভব হয়েছে, কিন্তু সমস্যা হয়েছে অন্য যায়গায়। উগান্ডা আমাদের দেশ থেকে প্রচুর অস্ত্র কেনে। ফলে উগান্ডার অনেক ন্যায়, অন্যায় অনুরোধ রাখতে হয়। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অর্থনীতি। এখানেও হয়তো তেমন কিছুই ঘটেছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজে ফোন করে মোগাম্বিকে ছেড়ে দেয়ার জন্য বললেন। আমি বললাম, "কিন্তু সে তো খুন করেছে, এবং সে এবং তার বন্ধু তা স্বীকার করেছে।"
: এ হত্যার অভিযোগ কে করেছে?
: কেউ করেনি, পুলিশ কেস। নিয়নার কথা বেমালুম চেপে গেলাম, নয়তো বেচারী নতুন কোন সমস্যায় পড়তে পারে।
: কেউ লাশের দাবি করেছে?
: এখন পর্যন্ত কেউ করেনি।
: সুতরাং সব কিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি না করাই ভাল। আমরা বুঝছি কোনটা ভাল আর কোনটা খারাপ। সুতরাং এ বিষয়ে আর কোন কথা শুনতে চাইছি না। যা বলছি কর।
: দুঃখিত স্যার, আপনার কথা রাখতে পারছিনা।
: তবে তোমাকে এ মূহুর্ত থেকে সাসপেন্ড করা হলো। পরবর্তি চার কর্মদিবসে আমার অফিসে রিপোর্ট করবে।
: না আপনি তা পারেন না।
: পারি চাঁদের আইন পৃথিবীর থেকে আলাদা। এটা তোমার জানা থাকার কথা।
: আইন আমি জানি, এবং আমি আপনার অফিসে রিপোর্ট করতে বাধ্য নই।
: না সেটাও তুমি পার না।
: পারি কারন, আমি আমার পদ থেকে ইস্তফা দিচ্ছি।
: সে তোমার ইচ্ছে।
ছয়.
এখানে সবাই কেন আইনের কাছ থেকে দূরে থাকতে চায়, তা এখন আমার কাছে পরিস্কার। অর্থের কাছে আইন এখানে পরাজিত, বিশেষ করে চাঁদে আইনকে যেন ইচ্ছে করেই শোষনের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হয়। আমার আর এক মূহুর্ত চাঁদে থাকতে ইচ্ছে করছে না। আমার কাছে মনে হচ্ছে আমি যেন নৃশংস রাজার ঝনঝনে তরবারি। নিজেকে কুৎসিত লাগছিল। তবে কাজটা ছেড়ে দিতে পেরে নিজেকে এখন হাল্কা লাগছে। ভাবতে ভাল লাগছে যে, আমি এই সব নোংরামির অংশ নই। আগামি কাল আমি পৃথিবীতে ফিরে যাচ্ছি। নিশ্চিত নিরাপদ জীবন থেকে আমি এক অনিশ্চয়তার জীবনের দিকে ধাবিত হচ্ছি। আমি জানি না আমার বর্তমান কি, কিই বা আমার ভবিষ্যত, কিন্তু এটা নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করছে না। আমার ভাল লাগছে যে পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার সময় আমি ফিরে যেতে পারবো আমার কৈশোরে। আমি প্রাণ ভরে উপভোগ করতে চাই আমার কৈশোর বেলা। ফিরে যাওয়ার সময় মাথার ভেতরে কৈশোরের যে স্মৃতি গুলোকে রোমন্থন করানো হবে, সেগুলো নিয়েই ভাবতে চাইছি। আমার কৈশোরের অভাব, অনটন নয় আমি শুধু আনন্দের স্মৃতি গুলোকে পেতে চাই।